সাংবাদিক বুলু ও বিভুরঞ্জনের মৃত্যু

দুই নদী, দুই শহর : এক পেশার নিঃশব্দ বিলাপ

নিয়াজ মাহমুদ

“সাংবাদিকতা হচ্ছে ইতিহাসের প্রথম খসড়া।”ফিলিপ গ্রাহাম (প্রাক্তন প্রকাশক, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট) এর এই বিখ্যাত উক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাংবাদিকরা কেবল সংবাদ লেখেন না, তারা সময়ের দলিল রচনা করেন। অথচ, বাংলাদেশে সেই ইতিহাসের খসড়া লেখার মানুষরাই আজ একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছেন, অনেকটা নিঃশব্দে, অনেকটা অনাদরে। খুলনার রূপসা সেতুর নিচ থেকে সাংবাদিক ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলুর লাশ উদ্ধার হওয়ার ঘটনাটি কেবল একটি অকাল মৃত্যু নয়, এটি গোটা সাংবাদিক সমাজের উপর ভর করা এক গভীর সংকটের প্রতীক।

মাত্র ৯ দিন আগে মেঘনা নদী থেকে পাওয়া গিয়েছিল আরেক প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকারের মরদেহ। দুই ভিন্ন নদী, দুই ভিন্ন শহর-কিন্তু পরিণতি একই। উভয়েই ছিলেন কলমের মানুষ, সংবাদপত্রের সাথে জীবন কাটানো নিরলস যোদ্ধা। আর্থিক অনটন, পেশাগত একঘেয়েমি, অবমূল্যায়ন আর সামাজিক অবহেলার মধ্যে দিয়ে তাঁদের জীবন শেষ হয়েছে নদীর জলে ভেসে।

বুলুর জীবন ও সংগ্রাম
খুলনার সাংবাদিক ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলু ছিলেন সৎ, নির্ভীক এবং নীতিনিষ্ঠ মানুষ। সহকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয়, ছিলেন সাহসী। সাংবাদিকতা তাঁর কাছে কখনো কেবল পেশা ছিল না, ছিল ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবার মঞ্চ।

তাঁর সহকর্মীদের মতে, বুলু কখনো আপস করেননি। রাজনীতির পাদপ্রদীপে না দাঁড়িয়েও তিনি মানুষের কথা লিখেছেন। অথচ, পেশার প্রতি এমন নিবেদিত একজন মানুষকেই জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে হলো নিঃশব্দে। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন ধরে তিনি ছিলেন আর্থিক সংকটে। বিদেশে পাড়ি জমাবার স্বপ্ন ছিল তাঁর, কিন্তু সেটিও পূরণ হলো না।

বিভুরঞ্জন সরকারের নিঃশব্দ প্রস্থান
অন্যদিকে, বিভুরঞ্জন সরকার ছিলেন খ্যাতিমান কলামিস্ট ও প্রবীণ সাংবাদিক। তিনি অসংখ্য পাঠকের মনে আলোড়ন তুলেছেন তাঁর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী কলাম দিয়ে। সমাজ-রাজনীতির প্রতিটি বাঁক তিনি বিশ্লেষণ করেছেন স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু জীবনের শেষভাগে তাকেও পেতে হয়েছে অভাব ও অবহেলার নির্মম বাস্তবতা।

যে মানুষটি কলম দিয়ে রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন, যিনি পাঠকের চিন্তাকে জাগিয়ে তুলতেন, তিনিই শেষ জীবনে হয়ে উঠলেন নিঃসঙ্গ। মেঘনার স্রোত তাঁকে কেড়ে নিল, রেখে গেল প্রশ্ন: সাংবাদিকতার জন্য কি এটাই প্রাপ্য?

ক্ষমতা বদলায়, ভাগ্য বদলায় না
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে বহুবার। রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়েছে, একইভাবে প্রেসক্লাবের কমিটি আর সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃত্বও বদলেছে। কিন্তু বদলায়নি প্রান্তিক সাংবাদিকদের ভাগ্য।

সত্য কথা হলো, সংগঠনের নেতৃত্বে যারা উঠে আসেন, তাঁদের অনেকেই সুবিধাবাদী। তাঁরা ক্ষমতার ছায়াতলে সুরক্ষিত থাকেন, চাকরি ও সুযোগ-সুবিধা পান। অথচ মাঠপর্যায়ের সৎ ও পরিশ্রমী সাংবাদিকরা থেকে যান অনিশ্চয়তার মধ্যে। তাদের জন্য নেই কোনো সামাজিক নিরাপত্তা, নেই পেশাগত নিশ্চয়তা।

ফলে, বুলুদের মতো মানুষরাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যান। তাঁদের মৃত্যুর পর হয়তো কিছুক্ষণ শোক প্রকাশ হয়, কিছু বিবৃতি আসে, কিন্তু দিন গড়ালেই সবকিছু আবার আগের মতো চলতে থাকে।

পেশার অবমূল্যায়ন ও আর্থিক অনটন
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখন সবচেয়ে অনিরাপদ পেশাগুলোর একটি। অধিকাংশ সাংবাদিক অনিয়মিত বা কম বেতনের চাকরিতে কাজ করেন। মাসের পর মাস বেতন পান না, কর্মসংস্থান অনিশ্চিত। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন মালিকরা প্রায়ই শ্রম আইন মানেন না।

এই পরিস্থিতিতে একজন সাংবাদিকের জীবনযাপন কতটা কষ্টকর, তা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। অথচ, এই সাংবাদিকরাই জনস্বার্থে কাজ করেন, দুর্নীতি উন্মোচন করেন, মানুষের পাশে দাঁড়ান। কিন্তু তাঁদের জীবনে নিরাপত্তা নেই, আর্থিক নিশ্চয়তা নেই, সম্মান নেই।

মৃত্যু শুধু ব্যক্তিগত নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা
ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলুর মৃত্যু কিংবা বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু-এগুলো নিছক ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়। এগুলো প্রমাণ করে, রাষ্ট্র ও সমাজ সাংবাদিকদের প্রাপ্য মূল্যায়ন দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

যদি সাংবাদিক সংগঠনগুলো সত্যিই তাঁদের সদস্যদের পাশে দাঁড়াতো, যদি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা থাকতো, তবে হয়তো বুলু আজো বেঁচে থাকতেন। হয়তো বিভুরঞ্জন সরকারের শেষভাগটা একটু হলেও মর্যাদাপূর্ণ হতো।

এক সমাজের আত্মপ্রবঞ্চনা
আমরা প্রায়ই বলি, গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু প্রশ্ন হলো-যে স্তম্ভকে আমরা রক্ষাকবচ ভাবি, সেই স্তম্ভের ভিত্তি কি আদৌ শক্ত? সাংবাদিকরা যদি প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন অথচ বিনিময়ে না পান অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, না পান সামাজিক মর্যাদা-তাহলে এই সমাজ আসলে কাদের জন্য টিকে আছে?

ইতিহাসের খসড়ায় অমোঘ প্রশ্ন
সাংবাদিকদের মৃত্যু আমাদের সামনে একটি অমোঘ প্রশ্ন রেখে যায়:“আমরা কি সত্যিই আমাদের সত্যকথক মানুষগুলোকে রক্ষা করতে চাই?”

যদি উত্তর ‘হ্যা’ হয়, তবে আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা গড়ে তুলতে হবে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-নৈতিক সাংবাদিকতার প্রতি শ্রদ্ধা ফেরাতে হবে।

রূপসা ও মেঘনার জলে ভেসে যাওয়া এই দুই সাংবাদিক কেবল ব্যক্তি নন, তাঁরা আমাদের পেশার প্রতিচ্ছবি। তাঁদের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, সাংবাদিকতার মাঠে কতটা অনিশ্চয়তা, কতটা অবহেলা, কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে।

ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলু এবং বিভুরঞ্জন সরকার-দু’জনেই ছিলেন কলমের যোদ্ধা। তাঁদের জীবন সংগ্রাম আমাদের শেখায়, সত্যের পথে হাঁটা সহজ নয়। আর তাঁদের মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজ ও রাষ্ট্র যদি সাংবাদিকদের পাশে না দাঁড়ায়, তবে একে একে হারিয়ে যাবে আরও অনেক বুলু, আরও অনেক বিভুরঞ্জন।

ফিলিপ গ্রাহাম যেমন বলেছিলেন, সাংবাদিকতা হচ্ছে ইতিহাসের প্রথম খসড়া। কিন্তু বাংলাদেশে সেই খসড়া লেখার মানুষগুলোই যদি নিঃশব্দে বিলীন হতে থাকেন, তবে ইতিহাসের পাতায় আমাদের জন্য রইবে শুধু নীরব অশ্রুবিন্দু আর অমোঘ আফসোস।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
email: niazjournalist@gmail.com

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন